গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী - ফিলিস্তিনের মুক্তির দূত-Ambassador of Palestine Liberation-Biography of sultan Gazi Salauddin Ayyubi

 গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী - ফিলিস্তিনের মুক্তির দূত


Ambassador of Palestine Liberation-Biography of sultan Gazi Salauddin Ayyubi


গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী - ফিলিস্তিনের মুক্তির দূত-Ambassador of Palestine Liberation-Biography of sultan Gazi Salauddin Ayyubi

আজ থেকে প্রায় ১০০০ বছর আগে যখন মুসলিমদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস ছিল খ্রিস্টানদের প্রধান শক্তির উৎস, তখন একজন সাহসী ও নির্ভীক মুসলিম কমান্ডার বলেছিলেন, জেরুজালেম যতদিন ক্রুসেডারদের দখলে থাকবে ততদিন আমি কি করে আনন্দ করতে পারি? আমি কী করে তৃপ্তি সহকারে উদরফূর্তি করতে পারি, আমি কী করে রাতের বেলায় শান্তিতে ঘুমাতে পারি।


আজ আমরা ইতিহাসের সেই ক্ষণজন্মা মানুষটির গল্প তুলে ধরতে যাচ্ছি, যিনি মাত্র সাত বছর বয়সে নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন ফিলিস্তিনের মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যতিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের একজন অকুতোভয় বীর সেনানী, যার দৃঢ়তা ছাড়িয়ে যায় পর্বতের উচ্চতাকে ও,


তিনি ছিলেন ক্রুসেডের মহানায়ক, যাঁর নেতৃত্বে মুসলিমদের পবিত্র স্থান বায়তুল মোকাদ্দাস, প্রায় ১০০ বছর পর খ্রিস্টানদের দখল মুক্ত হয়েছিল, তিনি জীবনভর পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, অথচ তাঁর বিরল ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে পাশ্চাত্যের ইতিহাসে তাঁকে স্থান দেওয়া হয়েছে, এক জন সমীহ জাগানো আদর্শ সমনায়ক হিসেবে, আর অভিহিত করা হয়েছে দ্য গ্রেট সালাহউদ্দিন নামে,


গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী - ফিলিস্তিনের মুক্তির দূত-Ambassador of Palestine Liberation-Biography of sultan Gazi Salauddin Ayyubi


তিনি বায়তুল মোকাদ্দাস এর ত্রাণকর্তা এবং জেরুজালেম ফিলিস্তিন বিজয়তাতার নাম আজও মুসলিম মানুষের অন্তরে রয়েছেতিনি গাজী সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহমতুল্লাহ আলাইহি। 


বাগদাদে একজন বিখ্যাত কাঠমিস্ত্রি বাস করতেন, তিনি আখরোট কাঠের এক জাঁকজমকপূর্ণ মিম্বার গড়ে তুলেছিলেন, যার সৌন্দর্য সবাইকে তখন খুবই মুগ্ধ করেছিলতখনকার সময় যখনই কেউ বাগদাদ ভ্রমণ করত, তারা সেই কাঠমিস্ত্রি সন্ধান করত, কেউ কেউ তাঁকে অনুরোধ করত মিম্বারটি আপনি আমাদের কাছে বিক্রি করে দেন, যেন আমরা মিম্বারটি কোন এক মসজিদে স্থাপন করতে পারি।


কিন্তু তিনি সবাইকে এক কথাই বলতেন, আমি এই মিম্বার বায়তুল মোকাদ্দাস এর জন্য নির্মাণ করেছি, এটা এমন এক সময়ের কথা, যখন মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত,


এক সময়কার জৌলুস হারিয়ে তখন নিভু নিভু আব্বাসীয় খিলাফত, মিশরের প্রতিষ্ঠিত ফাতিমীয় খিলাফত যাঁরা যতটা না ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের বিরুদ্ধে।


অন্যদিকে সকল পরাক্রম হারিয়ে, অভ্যন্তরীণ নানা সংঘাত ষড়যন্ত্রে পতনের দ্বারপ্রান্তে এককালের পরাক্রমশালী মুসলিম সেলজুক সাম্রাজ্য, এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বহু মুসলিম শাসনের উত্থান ঘটেছিল।


যারা কেউ কারও নেতৃত্ব স্বীকার করত না, ফলে মুসলিম উম্মাহ ছিল ঐক্যহীন বিভক্ত এক জনগোষ্ঠীর মতো,


আর এরই সুযোগ গ্রহণ করে খ্রিস্টানরা, ১০৯৫ সালে পোপ আরবান এর আহ্বানে প্রায় এক লক্ষ সৈন্যের এক বিশাল ক্রুসেডার বাহিনী প্রস্তুত করে জেরুজালেম অভিমুখে যাত্রা করে খ্রিস্টান শক্তি।


পথিমধ্যে বহু যুদ্ধ, জয় পরাজয়ের পর, ১০৯৯ সালে সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয় তারা, অতঃপর ৭ জুন জেরুজালেমে বায়তুল মোকাদ্দাস অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই শহরে প্রবেশ করে।


আর এর মধ্য দিয়ে পবিত্র ভূমি আলকুদসে ৪৬২ বছরের মুসলিম শাসনের সমাপ্তি ঘটে।

সেদিন ক্রুসেডাররা জেরুজালেমে রক্তের বন্যা বয়ে দিয়েছিল।


কী নারীকি পুরুষ, শিশু কি বৃদ্ধতারা যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। আর এভাবেই রক্তের উপর দাঁড়িয়ে ইউরোপীয়রা প্রতিষ্ঠা করে কিংডম অব জেরুজালেম।


মুসলিম ও ইহুদিদের উপর চলতে থাকে অকথ্য নির্যাতন, ক্রুসেডারদের প্রতি ছিল পোপের নিরবিচ্ছিন্ন সমর্থন। আর ইউরোপের সকল রাজ্যের সম্মিলিত সহযোগিতা।


অন্যদিকে মুসলিমরা ছিল ঐক্যহীন পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত, ফলে প্রায় ১০০ বছরের জন্য খ্রিষ্টানদের হাতে জিম্মি হয়ে যায় জেরুজালেম, এই ১০০ বছরে এক দিনের জন্য আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়নি ইসলামের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস এ, তথাপি প্রতিটি মুসলিমের স্বপ্ন ছিল একদিন তারা বায়তুল মোকাদ্দাস এর অধিকার ফিরে পাবেন।


ব্যতিক্রম ছিলেন না বাগদাদের ওই কাঠ মিস্ত্রি। তিনি অতিথিদেরকে বলতেন নিশ্চয়ই একদিন কোনও মহান ব্যক্তি আবির্ভাব ঘটবে, যিনি জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করবেন, সে দিন নিশ্চয়ই আমার এই মিম্বারটি তাঁর স্থান খুঁজে পাবে, কারুকার্যময় সেই মিম্বাবারের কথা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে, দূরের এক শহরে সাত থেকে আট বছরের এক বালকের কানেও পৌঁছে যায় বাগদাদের সেই বৃদ্ধ কাঠমিস্ত্রি আর তাঁর আবেগ মেশানো মিম্বারের কথা।


আর তখনকার প্রতিটি বালকের মতো সে ও জানতো জেরুজালেমে মুসলিমদের উপর বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের ঘটনা, বালকটি সেদিন আপন মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল সে একদিন বৃদ্ধ মানুষটির স্বপ্ন পূরণ করবে, অল্প বয়সেই সে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। আমি একদিন জেরুজালেম জয় করব, আর মিম্বারটিকে সেখানে স্থাপন করব।


বালকটির নাম আবু নাসির সালাহুদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। ইতিহাস যাঁকে চিনেছে সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী নামে।


সালাউদ্দিন ইরাকের তিকরিত শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা নাজিম উদ্দিন আইয়ুব ছিলেন কুর্দী বংশোদ্ভূত একজন শাসক। তবে বাল্যকালে সালাহউদ্দিনের সামরিক বিষয়ে হাতেখড়ি হয় তার চাচা আসাদুদ্দিন শিরকুর হাত ধরে, সালাহউদ্দিন যখন বেড়ে ওঠেন, ভাগ্য তার জেরুজালেম জয়ের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল।


একজন সাধারণ সেনা থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ সামরিক ব্যক্তিত্ব ও দক্ষ শাসক। আর ইতিহাসে একজন সালাহউদ্দিন আইয়ুবির এই উত্থানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন, আর এক জন মহান সমনায়ক নুরউদ্দিন জঙ্গি। নূরুদ্দীন ছিলেন জেনগি বংশের সুলতান। যিনি সমস্ত তুর্কি শাসকদের কে তার অধীনে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।


বিচ্ছিন্ন মুসলিম বিশ্বের ঐক্য কে তিনি যতটা সম্ভব ফিরিয়ে এনেছিলেন। তিনি ক্রুসেডারদের হাত থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বহু শহর পুনরুদ্ধার করেছিলেন।


আর তার হাত ধরেই বিকশিত হয়েছিল সালাহউদ্দিনের সামরিক প্রতিভা, নুরউদ্দিন জঙ্গির শাসন আমলে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ক্রুসেডাররা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করছিল।


১১৫৮ সালে তারা মিশরের রাজধানী কায়রোতে আক্রমণ করে। মিশর তখন শাসন করেছিলেন ফাতেমীয় খলিফা আল-আদিদ। 


ক্রুসেডারদের মোকাবেলায় তিনি নিজেকে অসহায় অনুভব করেন এবং নুরউদ্দিন জেনগির সাহায্য প্রার্থনা করেন। নুরউদ্দিন তাতে সাড়া দিয়ে সালাহউদ্দিন আইয়ুবির চাচা আসাদ উদ্দিন শেরকুর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেন।


সেই সেনাবাহিনীতে আসাদ উদ্দিন শেরকুর বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন তার তরুন ভাতিজা সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, এই বাহিনী মিশর থেকে ক্রুসেডারদেরকে বিতাড়িত করতে সমর্থ হয়, অতঃপর আসাদ উদ্দিন শেরকুকে মিশরের উজির হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।


তার কিছু দিন পর আসাদ উদ্দিন শেরকু মৃত্যুবরণ করলে তাঁর একান্ত সহযোগী ভাতিজা সালাহউদ্দিনকে দেওয়া হয় উজিরে মিশনের দায়িত্ব,এর কিছুকাল পর, ফাতিমিয় খলিফা আল আদিদ মারা যান।


নুরউদ্দিন জঙ্গির নির্দেশে সালাহউদ্দিন তখন মিশরের ক্ষমতা দখল করেন এবং ফাতেমীয় খিলাফতের বদলে আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তিনি এক হাতে মিশরে ফাতেমীয়দের বিদ্রোহ দমন করেন। অন্য হাতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেন।


অসামান্য দক্ষতা ও নেতৃত্ব গুণে মাত্র ৩১ বছর বয়সে মিশরে নিজের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী, সালাহউদ্দিন যখন মিসরে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। তখন তাঁর কাছে আসে এক ভয়ানক দুঃসংবাদ, সুলতান নুরউদ্দিন জঙ্গিকে হত্যা করা হয়েছে।


নুরউদ্দিন জঙ্গির এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যু সালাহউদ্দিনকে হতবিহ্বল করে দেয়। কেননা মুসলিম বিশ্বে দ্বিতীয় কোন নেতা ছিল না যার অধীনে মুসলিমরা ঐক্যের পথ সুগম হয়েছিল। আর যার তলোয়ার নুরউদ্দিন জঙ্গির মতো এতটা ধারালো ছিল, নুরউদ্দিন জঙ্গির মৃত্যুর পর সালাউদ্দিন আইয়ুবী তার সামনে নেতৃত্বে তীব্র শূন্যতা অনুভব করেন।


আর এই অবস্থায় নিজের আজীবন লালিত স্বপ্ন আর নুরউদ্দিন জঙ্গির অসমাপ্ত কাজ তাঁকে প্রতিনিয়ত তারনা দিতে থাকে।


অতঃপর নিজের পথ নিজেই রচনা করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, ১১০০ চুয়াত্তর সালে মারা যান নুরউদ্দিন জঙ্গি, তাঁর মৃত্যুর ১৩ বছর পর ফিলিস্তিন জয় করেন গাজী সালাউদ্দিন আইয়ুবী।


এই ১৩ বছরে তিনি মিশরের পাশাপাশি সিরিয়া মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়েমেন ও উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ এলাকায় নিজের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন।


তিনি গড়ে তোলেন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ নিয়মিত সেনাবাহিনী। এর বাইরেও অসংখ্য অনিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন, যাঁরা উম্মার যে কোন প্রয়োজনে নিজেদের জীবন সম্পদ উৎসর্গ করে যুদ্ধের ময়দানে সামিল হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল।


সালাউদ্দিনের সকল সামরিক তৎপরতার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ক্রুসেডারদের হাত থেকে জেরুজালেমকে পুনরুদ্ধার করা।


কুষ্টু রোগে আক্রান্ত জেরুজালেমের রাজা চতুর্থ বাল্ডউইন যতদিন বেঁচে ছিলেন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী জেরুজালেম আক্রমণ করেননি। বাল্ডউইন জেরুজালেমে মুসলিমদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে শান্তিচুক্তি করেছিলেন।


এবং রাজা বাল্ডউইন যতদিন বেঁচে ছিলেন এই চুক্তির প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বাল্ডউইন শেষ জীবনে ক্রুসেডারদের একজন জেনারেল রেইনল্ড অব শাটিলন মুসলিমদের একটি কাফেলাতে হামলা করে এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়।


খবর পেয়ে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী জেরুজালেম অভিমুখে রওনা হন, কিন্তু রাজা চতুর্থ বাল্ডউইন চুক্তি ভঙ্গ করায় রেনল্ডকে বন্দী করেন, এবং সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে দুঃখপ্রকাশ করে পুনরায় শান্তির আহ্বান জানানসালাহউদ্দিন আইয়ুবী তাঁর অনুরোধ মেনে নিয়ে ফিরে যান।


এই ঘটনার অল্পকাল পরেই চতুর্থ বাল্ডউইন মারা যান, তাঁর মৃত্যুর এক বছর পর জেরুজালেমের সিংহাসনে বসেন গাই অব লুসিগনান, ক্ষমতায় বসেই তিনি বিশ্বাসঘাতক রেইনল্ড অব শাটিলন কে মুক্ত করে দেন।


আর রেনল্ট তাঁর মুসলিম বিদ্বেষ প্রদর্শন করতে এতটুকুও দেরি করে না, পুনরায় সে চুক্তি লঙ্ঘন করে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হামলা করে, এবং নির্বিচারে মুসলিমদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়।


এমনকী তারা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বোনকে হত্যা করে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে যখন এই সংবাদ পৌঁছে তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে জেরুজালেম অভিমুখে রওনা হন।


তিনি জানতেন এবার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই ক্রুসেডাররা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, সুতরাং তিনিও যুদ্ধের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যান।


১৮৮৭ সালের ৪ জুলাই জেরুজালেমের নিকটস্থ হিত্তিন নামক স্থানে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মুখোমুখি হয় ক্রুসেডারদের সবচেয়ে বড় বাহিনী৷


৩০,০০০ আইয়ুবী সেনার বিপরীতে ছিল ৫০,০০০ ক্রুসেডার সেনা, আর ক্রুসেডারদের সম্মিলিত এই বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার ছিলেন জেরুজালেমের রাজা গাই অব লুসিগনান, তবে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছানোর আগেই ক্রুসেডাররা হেরে গিয়েছিল কৌঁসুলি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে।


হিত্তিনে অসংখ্য পানির কূপ ছিলো যেগুলো ছিল তীব্র গরমে যোদ্ধাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনসালাহউদ্দিন আইয়ুবী সেগুলো দখল করে নেন, এবং বাকিগুলো ধ্বংস করে দেন।


হিত্তিনে পৌঁছে পানির অভাবে খ্রিস্টান সেনারা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, আয়ুবীর সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরার মতো শক্তি তাদের অবশিষ্ট ছিল না, ফলে নিজেদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আইয়ুবীর বাহিনী ক্রুসেডারদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন।


৫০,০০০ খ্রিস্টান যোদ্ধার মধ্যে মাত্র ৩০০০ সেনা পালাতে সক্ষম হয়। বাকিদেরকে হত্যা ও বন্দী করা হয়।


অতঃপর বন্দি রাজা ও কমান্ডারদেরকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সামনে আনা হয়। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তার চিরাচরিত উদার যে নিদর্শন হিসেবে তৃষ্ণায় কাতর রাজা গাই অব লুসিগনান এর হাতে বরফ মেশানো পানির পাত্র তুলে দেন, বিব্রত গাই অব লুসিগনান তা পান না করে বরং রেনল্টের দিকে এগিয়ে দেন, রেনল্ট নির্লজ্জের মতো তা গিলতে শুরু করে।


অতঃপর সালাউদ্দিন রেনল্টকে চুক্তি লঙ্ঘনকারী ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিযুক্ত করেন, রেনল্ট অধ্যক্ষের সাথে জবাব দেয় রাজারা সবসময় এভাবেই কাজ করে, আমি এর বেশি কিছু করিনি,তার উত্তর শুনে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী নিজের তরবারি দিয়ে উদ্ধত রেনল্টের মস্তক আলাদা করে দেন।


ফিলিস্তিনের রাজা ও নিজের ব্যাপারে একই পরিণতির কথা কল্পনা করে চোখ বন্ধ করে ফেলেন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন, একজন রাজা কখনো অপর রাজাকে হত্যা করে না, রেনল্টকে হত্যা করেছি কারণ সে বিশ্বাসঘাতকতার সকল সীমা অতিক্রম করেছে।


অতঃপর তিনি গাই অব লুসিগনান কে বন্দী করেন, এবং পরবর্তীতে তাকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্ত করে দেন, হিত্তিন যুদ্ধে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ধাপে ধাপে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হন।


ক্রুসেডারদের মূল বাহিনীর পরাজয় মুসলিম ফৌজের সামনে নিকটস্থ সব শহর আর দূর্গ জয়ের পথ খুলে দিয়েছিলসালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সেনারা একে একে রামলা, টাইবেরিয়াস, এসকালণ, আঁক্কা, নেবলুস ও গাজা দখল করে নেয়।


মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ছোট বড় মিলিয়ে ৫২ টি শহর মুসলিমদের দখলে চলে আসে, অতঃপর তারা রওনা হন, ১০০ বছর ধরে মুসলিমদের রক্ত, আর অশ্রু ভেজা জেরুজালেম জয় করার উদ্দেশে।


১১৮৭ সালের ২০সেপ্টেম্বর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সেনারা জেরুজালেম অবরোধ করেন, দুর্গের ভিতর থেকে তখন শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন ইভলিনের শাসক ভেলিয়ন, তিনি আইয়ুবীর সেনাবাহিনীকে দুর্গের বাইরে বেশ কয়েকদিন আটকে রাখতে সমর্থ হন।


সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মিনজানিক যন্ত্রের সাহায্যে বড় বড় পাথর ছুড়ে দুর্গের প্রাচীর ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই প্রাচীর এতটাই মজবুত ছিল যে তা পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে৷


তবে শেষ পর্যন্ত উত্তর দিকের দেওয়ালে হামলা চালিয়ে সফলতা পান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, ওই পাশের দেওয়াল কিছুটা দুর্বল ছিল কয়েকটি পাথরের আঘাতেই তা ধসে পড়ে ভেলিয়নের নেতৃত্বে তার সেনারা সেখানে প্রাণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে, এবং অকাতরে জীবন দিতে থাকে।


তবে ভেলিয়ন জানতেন তিনি শেষ রক্ষা করতে পারবেন না, তিনি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে শর্ত সাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন, তিনি বলেন আমাদের সকল সেনা ও সাধারণ নাগরিককে নিরাপদে শহর ত্যাগ করতে দিতে হবে, নইলে আমরা এই শহরের সব কিছু ধ্বংস করে দেব, এমনকি আমাদের হাতে বন্দী ৫০০০ মুসলিমকে হত্যা করব।


আর যদি আমাদেরকে নিরাপদে বের হতে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা মুক্তিপণ দেবো, এই শহরের কোন ফসল নষ্ট করব না, কোন ঘর বাড়ি নষ্ট করব না, আর আমাদের হাতে বন্দি মুসলিমদেরকে মুক্ত করে দেব, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী র্নিদিধায় তার সকল শর্ত মেনে নেন, কেননা তিনি খ্রিস্টানদের উপর বদলা নিতে আসেননি, তিনি এসেছেন জুলুমের রাজত্ব থেকে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে।


তরুণ কমান্ডার ভিলিয়ন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারছিলেন না, তিনি সংশয় প্রকাশ করে বলেন, খ্রিস্টান যোদ্ধারা এই দুর্গ জয় করার পর মুসলিমদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল, আজ আমরা আত্মসমর্পণের পর আপনিও যে খ্রিস্টানদেরকে নির্বিচারে হত্যা করবেন না তার নিশ্চয়তা কী?


সালাহউদ্দিন আইয়ুবী উত্তর এ বলেন, আমি তাঁদের মতো নই, আমি সালাহউদ্দিন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আমি, অতঃপর খ্রিস্টান সেনারা দুর্গ ত্যাগ করে, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে জেরুজালেমের সমাপ্তি ঘটে।


ক্রুসেডারদের টানা নয় দশকের শাসন দীর্ঘ ৮৮বছর পর সেখানে উচ্চারিত হয় আযানের ধ্বনি, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যতদিন বেঁচে ছিলেন, ক্রুসেডাররা পুনরায় জেরুজালেম দখল করার বহু চেষ্টা করছে।


রাজা রিচয়ার্ডের মতো দুর্ধর্ষ কমান্ডার ইংল্যান্ড থেকে ছুটে আসেন, আর তার অগণিত সাহসী যোদ্ধাকে নিয়ে জেরুজালেম দখল করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর তরবারির সামনে, তাদের সব চেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ে।


১১৯৩ সালের ৪ মার্চ সিরিয়ার দামেস্কে ইহলোক ত্যাগ করেন ইসলামের ইতিহাসের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী (রাঃ)।


মৃ*ত্যুর সময় তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে ছিল মাত্র ১টি স্বর্ণমুদ্রা আর ৪০ টি রৌপ্য মুদ্রা, অথচ তিনি ছিলেন তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে দাপুটে শাসক, সারা জীবনের অর্জিত সম্পদ তিনি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছিলেন।


সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তাঁর জীবনের এক মহান লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন মুসলিম উম্মাহর প্রতিশ্রুতিশীল একজন নেতাঅনুকরণীয় শাসক আর দিগ বিজয়ী সেনাপতি।


জনগণ আর সেনারা তাকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসত, আর তার জন্য অকাতরে জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল, তিনি দেখেছিলেন কী ভাবে একজন মুসলিমকে নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়, আর সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জীবনভর সংগ্রাম করতে হয়।


ক্রুসেডাররা যখন জেরুজালেম দখল করেছিল তখন তারা বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে কেবল মুসলিম নয় ইহুদিদেরকে উচ্ছেদ করেছিল। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করার পর সেখানে মুসলিমদের পাশাপাশি খ্রীস্টান আর ইহুদিদেরকে ও ধর্মীয় আচার পালনের পূর্ণ অধিকার দিয়েছিলেন।


অথচ সেই পবিত্র ভূমিতে সেই ইহুদিদের হাতে আজ মুসলিম নিধন চলছে, গত প্রায় ১০০ বছর ধরে।


এই একশ বছরের ইতিহাসেমুসলিম বিশ্বে শত কোটি মানুষের জন্ম হয়েছে, কোটি কোটি ঘরে মিলাদ হয়েছে, ফিলিস্তিন বাসীদের জন্য মোনাজাত হয়েছে, অগণিত ওয়াজ মাহফিলে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে গর্জন উঠেছে, আর ইজতেমার মাঠে হতভাগা ফিলিস্তিনিদের জন্য কান্নার মাতম উঠেছে, জাতিসংঘের অসংখ্য অধিবেশনে আলোচনা হয়েছে, দেশে দেশে মুসলিমরা, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে, তাদের নেতারা অগ্নিঝরা জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়েছে, কিন্তু এই একশ বছরের ইতিহাসে হতভাগ্য মুসলিমদের ঘরে একজন সালাহউদ্দিন আইয়ুবির জন্ম হয়নি।


এই একশ বছরের ইতিহাসে ঐক্যহীন মুসলিম জাতি একটি দিনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি।



ইসলামিক মিডিয়া

মোঃ আহসান হাবীব

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.